প্রশ্নঃ শরীয়তের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিধান কী ?
উত্তরঃ বর্তমানে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি চালু আছে। কিছু স্থায়ী পদ্ধতি। কিছু অস্থায়ী পদ্ধতি।
–স্থায়ী পদ্ধতি বলতে বুঝায়, এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যার কারণে পুরুষ বা নারীর প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তবে এতে যৌন ক্ষমতা নষ্ট হয় না। নিম্নে কয়েকটি স্থায়ী পদ্ধতি উল্লেখ করা হল:-
–স্থায়ী পদ্ধতি:
১. ভ্যাসেক্টমি (VASECTOMY) (পুরুষের জন্য)। এই পদ্ধতিতে পুরুষের শুক্রবাহী দু‘টি নালী কেটে নালীর মুখ সুতা দিয়ে শক্তভাবে বেঁধে দেয়া হয়।
২. টিউবাল লাইগেশন (TUVAL LIGATION) (মহিলাদের জন্য)। অর্থাৎ অপারেশনের মাধ্যমে (ফেলোপিয়ন টিউব) ডিম্ববাহী নালি কেটে বেঁধে দেওয়া হয়। ফলে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্ব জরায়ুতে আসতে পারে না। (যদিও এ কারণে যৌন ক্ষমতা, বীর্য স্খলন ও মাসিক চালু থাকে)
৩. হিসটারেকটমি (HYSTERECTOMY) (জরায়ুচ্ছেদ)। এই পদ্ধতিতে জরায়ু কেটে ফেলা হয়।
৪. কোন ঔষধ বা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে কিংবা অন্যকোন পন্থায় প্রজনন ক্ষমতা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া।
–বিধানঃ
স্বাভাবিক অবস্থায় উপরোক্ত যে কোন পদ্ধতি বা অন্য কোন পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করা হারাম।
দেখুন: ( হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা :وكذلك جريان الرسم بقطع أعضاء النسل و استعمال الادوية القامعة للباه والتبتل وغيرها تغيير لخلق الله واهمال لطلب النسل اهـ
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে স্থায়ীভাবে প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করার পদ্ধতি ছিল খাসি হয়ে যাওয়া অর্থাৎ অণ্ড-কোষ কেটে ফেলা । হাদীসে একে নিষেধ করা হয়েছে,
عَنْ قَيْسٍ قَالَ قَالَ عَبْدُ اللَّهِ كُنَّا نَغْزُو مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَيْسَ لَنَا شَيْءٌ فَقُلْنَا أَلَا نَسْتَخْصِي فَنَهَانَا عَنْ ذَلِكَ ثُمَّ رَخَّصَ لَنَا أَنْ نَنْكِحَ الْمَرْأَةَ بِالثَّوْبِ ثُمَّ قَرَأَ عَلَيْنَا { يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُحَرِّمُوا طَيِّبَاتِ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ }
“হযরত কায়েছ (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের সাথে জিহাদে যেতাম, আর আমাদের সাথে জৈবিক চাহিদা মিটানোর কোন কিছু থাকতো না (এতে আমরা যৌন পীড়নে ভুগতাম )। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে খাসি হওয়ার অনুমতি চাইলাম, কিন্তু তিনি আমাদেরকে এটা করতে নিষেধ করেছেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫৯৭৫)
–অবশ্য কোন জরায়ুতে ক্যান্সার বা এমন কোন রোগ যদি হয়, যার কারণে জরায়ু কেটে ফেলা ছাড়া কোন উপায় থাকে না, সেক্ষেত্রে জরায়ু কেটে ফেলা জায়েয আছে। (যদিও এর কারণে সন্তান ধারণের ক্ষমতা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়)। দেখুন: قرار مجمع الفقه الاسلامي بجدة ৩৯(১/৫) يحرم استئصال القدرة على الإنجاب في الرجل أو المرأة وهو ما يعرف بالإعقام أو التعقيم ما لم تدع إلى ذلك الضرورة بمعانيها الشرعية
–কিংবা অভিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য ডাক্তার যদি সিদ্ধান্ত দেন যে, সন্তান ধারণ করলে প্রাণহানি বা কোন অঙ্গহানির প্রবল আশংকা আছে; তাহলে সেক্ষেত্রেও স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করা বৈধ।
দেখুন: ফতোয়ায়ে রহিমিয়া, খ.১০ , পৃ. ১৮১; ফতোয়া মাহমুদিয়া, খ.১৮,পৃ. ২৯০; আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, খ. ৮,পৃ. ৪৮৯)
–অস্থায়ী পদ্ধতিঃ
মহিলা পুরুষ উভয়ের জন্যই অস্থায়ী পদ্ধতি রয়েছে। যেমনঃ
১. আযল (with drawl) অর্থৎ যৌন মিলনে বীর্যপাত যৌনাঙ্গের বাহিরে ফেলা।
২. সেফ পিরিওড (safe period) বা সহবাস নিয়ন্ত্রন: অর্থাৎ যে দিনগুলোতে ডিম্বানু নিষ্ক্রমণ হয় সে দিনগুলো মিলন থেকে বিরত থাকা। এটি জানার সহজ পদ্ধতি হল, প্রথমে জানুন, মাসিক নিয়মিত কিনা? যদি নিয়মিত না হয় তথা কখনো বেশি দিন পর হয়, কখনো অল্প দিন পর হয়, তাহলে সবচেয়ে কম যতদিন পর মাসিক হয় তা থেকে ১৮ দিন বাদ দিতে হবে। আর সবচেয়ে বেশি যত দিন পর হয় তা থেকে ১০ দিন বাদ দিতে হবে। যেমন: কারো ২৮-৩০ দিন পর মাসিক হয়, তাহলে এখানে ২৮ হল সবচেয়ে কম দিন। সুতরাং ২৮-১৮= ১০ দিন। এর অর্থ মাসিক শুরুর পর থেকে প্রথম ৯ দিন নিরাপদ। ১০তম দিন থেকে অনিরাপদ দিন শুরু। আবার ৩০ দিন হল সবচেয়ে বড় দিন। সুতরাং ৩০-১০= ২০ দিন। এর অর্থ ২১তম দিন থেকে আবার নিরাপদ দিন শুরু হবে মাসিক শুরুর আগ পর্যন্ত। দেখুন: জন্ম নিয়ন্ত্রনের সঠিক নিয়ম, ডা. সুমন চৌধুরী।
৩. কনডম ব্যবহার করা।
৪. স্পার্মিসাইড: এই পদ্ধতিতে জেলি, ফোম, ক্রীম, ফ্লিম ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে শুক্রানু নষ্ট করে দেওয়া হয় ।
৫. ডায়াফ্রাগাম ব্যবহার করা: এটি রাবারের তৈরি একটি ডোম বা গম্বুজ বিশেষ যা যৌনসঙ্গমের পূর্বে সারভিক্সে লাগিয়ে নিতে হয়। এর সাথে স্পার্মিসাইড ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
৬. ঢুস: অর্থাৎ পানির পিচকারী দিয়ে জরায়ু ধুয়ে ফেলা হয়।
৭. পিল বা জন্ম নিয়ন্ত্রক ঔষধ। এ পদ্ধতি সবচেয়ে বেশী প্রচলিত। তবে এক্ষেত্রে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যেমন: উচ্চ রক্তচাপ, রক্তজমাট বাঁধা, মুখে বা শরীরে বিভিন্ন স্থানে দাঁগ পড়া ইত্যাদি। দেখুন: জাদিদ ফিকহি মাবাহিছ :৭/২৬৬
৮. ইঞ্জেকশন গ্রহণ করা।
–বিধানঃ
উপরোক্ত আটটি পদ্ধতির মাঝে ২য় পদ্ধতিটি গ্রহণ করা জায়েয। এছাড়া বাকি সাতটি পদ্ধতি শরীয়ত সম্মত কারন ছাড়া গ্রহণ করা অনুত্তম। দেখুন: শরহুন নাবাবী 1/464 ثم هذه الأحاديث مع غيرها يجمع بينها بأن ما ورد في النهى محمول على كراهة التنزيه وما ورد في الاذن في ذلك محمول على أنه ليس بحرام وليس
–যেসব ক্ষেত্রে অস্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করার অবকাশ রয়েছে:
জন্ম নিয়ন্ত্রণের অস্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কিছু ওযর আছে, যা শরীয়ত সমর্থন করে। আর কিছু ওযর আছে, যা শরীয়ত সমর্থন করে না। শরীয়ত সমর্থিত ওযরগুলোর জন্য যদি নিয়ত সহীহ রেখে সাময়িক সময়ের জন্য অস্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় তবে তা বৈধ। নিয়ত সহীহ না থাকলে নিয়তের কারণে বৈধ হবে না। পক্ষান্তরে যে সকল ওযর শরীয়ত সমর্থন করে না সেগুলোর ক্ষেত্রে নিয়ত সহীহ হলেও তা বৈধ হবে না। নিম্নে কিছু শরীয়ত সমর্থিত ওযর উল্লেখ করা হলঃ
১. মহিলা অধিক দূর্বল হওয়ার কারণে গর্ভধারণে সক্ষম না হওয়া বা প্রসবের ক্ষমতা না থাকা।
দেখুন: জাওয়াহিরুল ফিকহ ৭/৮৮, করারুল হিন্দ ১/৩৯০, ফিকহুল নাওয়াযেল ৪/১৮, জাদীদ ফিকহি মাবাহেস ১/৩১৪, ৩১৮, ৩২৭
২. সন্তান ধারণ করলে প্রাণহানি বা অঙ্গহানির আশংকা থাকা। দেখুন: প্রাগুক্ত
৩. গর্ভধারণের কারণে দুধ শুকিয়ে গেলে পূর্বের বাচ্চার স্বাস্থহানীর আশঙ্কা দেখা দেওয়া এবং দুধের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণে সামর্থ্য না থাকা। দেখুন: জাওয়াহিরুল ফিকহ ৭/৮৮
৪. মা সফরে থাকা, যেখানে স্থায়ীভাবে অবস্থানের ইচ্ছা নেই। দেখুন: প্রাগুক্ত
৫. স্বামী স্ত্রী বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া, এ অবস্থায় বাচ্চা নিলে তার লালন পালন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকা। দেখুন: জাদিদ ফিকহি মাবাহিস ১/৩১৭, ৩২৭
৬. মা বংশগত (জেনেটিক) কোন মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়া যা বাচ্চার মাঝে সংক্রমিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
দেখুন: قرار مجمع الفقه الاسلامي بجدة (১/৫) يجوز التحكم المؤقت في الإنجاب بقصد المباعدة بين فترات الحمل أو إيقافه لمدة معينة من الزمان إذا دعت إليه حاجة معتبرة شرعا بحسب تقدير الزوجين عن تشاور بينهما وتراض بشرط أن لا يترتب على ذلك ضرر
৭. প্রত্যেক সন্তানকে যথাযথ লালন পালনের ক্ষেত্রে সমস্যা হলে দুই সন্তানের মাঝে পর্যাপ্ত বিরতি দেওয়া, যা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কম-বেশি হতে পারে। দেখুন: (জাদীদ ফিকহী মাবাহেস, ১/৩১৪-৩১৮)
৮. মায়ের মানসিক অসুস্থতা থাকা, যেমন: পাগল বা অস্বাভাবিক হওয়া, মানসিক ভারসম্যতা না থাকা। দেখুন: (আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ কুয়েতিয়্যাহ, ৩০/৩৫)
৯. অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার প্রবল আশংকা থাকা যা সহ্য করার মতো নয়। দেখুন: (জাদীদ ফিকহী মাবাহেস, ১/৩১৪-৩৩১)
১০. কোন কারণে মা সন্তান লালন পালনে অক্ষম হওয়া। এবং এর বিকল্প ব্যবস্থা না থাকা। দেখুন: (কারারুল মক্কায়ে মুকাররমা, কারারু হাইআতি কিবারিল উলামা)
১১. অভিজ্ঞ ডাক্তারদের ভাষ্যানুযায়ী মা স্বাভাবিক প্রসবে অক্ষম হওয়া। বাচ্চা ধারণ করলে সিজারে বাধ্য হওয়া। দেখুন: ( আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ কুয়েতিয়্যাহ, ৩০/৩৫)
১২. মা দারুল হরব বা কাফের রাষ্ট্রে অবস্থান করা। এবং সন্তানের ব্যাপারে কুফরির আশংকা করা। দেখুন: প্রাগুক্ত
১৩. যামানার ফেতনা ফাসাদের কারণে সন্তান অসৎ চরিত্র হওয়ার আশংকা করা।
–এসব ক্ষেত্রে নিয়ত ও উদ্দেশ্য সহীহ হলে অস্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করা বৈধ। প্রকাশ থাকে যে, নিয়ত সঠিক হওয়ার অর্থ হল, আল্লাহ তাআলাকে একমাত্র খালেক ও রিযিকদাতা জ্ঞান করা। সন্তান গ্রহণ করলে রিযিক কমে যাবে এমন ভ্রান্ত ধারণা না করা।
–যেসব ক্ষেত্রে অস্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করা বৈধ নয়:
নিম্নে এমন কিছু ওযর উল্লেখ করা হল যা শরীয়ত সমর্থন করে না। নিয়ত সহীহ হলেও এসব পদ্ধতি গ্রহণ করা নাজায়েয। যেমনঃ
১. সন্তান নিলে দরিদ্র হওয়ার কল্পিত আশঙ্কা করা।
২. অধিক সন্তান নেওয়াকে লজ্জার কারণ মনে করা।
৩. কন্যা সন্তান হওয়ার ভয়ে, যাতে পরবর্তীতে এদের বিয়ে-শাদীর ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৪. “ছোট ফ্যামেলি ”একটি ফ্যাশনে রুপ নিয়েছে। এই ফ্যাশন গ্রহণের ইচ্ছায় বাচ্চা না নেওয়া।
৫. গর্ভ থেকে নিয়ে বাচ্চা প্রসব পর্যন্ত । এরপর বড় হওয়া এমনকি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সন্তানের পেছনে সীমাহীন মেধা, সময় ও অর্থ ব্যয়ের ঝামেলায় না জড়ানো।
৬. মহিলার সৌন্দর্য দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যে সন্তান না নেওয়া।
৭. গর্ভধারণের কষ্ট, প্রসব বেদনা, নিফাস, (সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পরবর্তী স্রাব) দুধ পান করানো এবং এর সেবাযত্ন ইত্যাদির কষ্ট থেকে বেঁচে থাকার জন্য সন্তান না নেওয়া।
জন্ম নিয়ন্ত্রণের উপরোক্ত কারণগুলো শরীয়তের দৃষ্টিতে গ্রহনযোগ্য কোন কারণ নয় ।
–এছাড়া“ ছোট ফ্যামেলি ” একটি ফ্যাশন বা অধিক সন্তান লজ্জার কারণ ইত্যাদি কারণগুলো শরীয়ত সম্মত কারণ নয়। বরং হাদীসে অধিক সন্তানগ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম ইরশাদ করেন,
” تَزَوَّجُوا الْوَدُودَ الْوَلُودَ فَإِنِّى مُكَاثِرٌ بِكُمُ الأُمَمَ “
“ তোমরা এমন নারীদেরকে বিবাহ করো যারা স্বামীদেরকে অধিক মহব্বত করে এবং অধিক সন্তান প্রসব করে । কেননা আমি (কিয়ামতের দিন ) তোমাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে পূর্ববর্তী উম্মতের উপর গর্ব প্রকাশ করবো। (আবু দাউদ, হাদীস: ২০১০)
///–প্রস্তুত করেছেন: মাওলানা মুহাম্মদ তাওহীদুল ইসলাম